ষষ্ঠ শতাব্দীর দ্বিতিয়ার্ধে আরবে রাজনৈতিক বৈষম্যের কারনে
যোগাযোগের কোন নিরাপদ পথ ছিলো না । ধর্মীয় গোত্রগুলো বিষেশ কারনে বিবাদমান ছিলো ।
যখন খ্রিস্টানরা ইরানে ছিলো, তখন ইয়েমেনে ইহুদীধর্ম প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিলো । আর
আরবের অনেকেই বহুঈশ্বরে বিশ্বাসী ছিলেন । ইসলামী যুগের প্রাক্কালে “কুরাইশ”-রা ছিলো
মক্কার প্রধান গোত্র এবং পশ্চিমা আরবের অন্যতম প্রভাবশালী বাহিনী । অরাজকতা
প্রতিরোধে তারা “পবিত্র মাস” প্রতিষ্ঠা করে । এ সময় সকল প্রকার সহিংসতা নিষিদ্ধ করা
হয় এবং যাতায়াত নিরাপদ ছিলো । মক্কা এবং পার্শবর্তী এলাকায় “কাবা” ঘরের জনপ্রিয়তা
ছিলো, যা শহরটিকে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক এলাকায় পরিনত করেছিলো ।
তৎকালীন আরব অর্থনীতির মূল
ভিত্তি ছিল ব্যবসায় ও পশুপালন । নোমেডীয় অঞ্চলের সাথে এখানকার বাণিজ্য যোগাযোগ ছিল । আরব বলতে এখানে মক্কা ও মদিনা এবং এদের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলো নিয়ে গড়ে উঠা অংশকে
বুঝানো হচ্ছে,
এই অংশের সাথেই মুহাম্মাদের(সঃ) জীবনের সরাসরি সম্পৃক্ততা ছিল ।
জন্ম
মুহাম্মাদ(সঃ) বর্তমান সৌদি
আরবে অবস্থিত মক্কা নগরীর কুরাইশ বংশের বনু
হাশিম গোত্রে
জন্ম গ্রহণ করেন । প্রচলিত ধারণা মতে, তিনি ৫৭০খ্রিষ্টাব্দের ২৯
আগস্ট বা
আরবি রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ জন্মান ।
শৈশব ও কৈশোর কাল
মুহাম্মাদ (সা.) এর পিতা আবদুল্লাহ
ইবনে আবদুল মুত্তালিব তার
জন্মের প্রায় ছয় মাস পূর্বে মৃত্যুবরণ করেন । আরবের
রীতি অনুসারে হয়রত মুহাম্মাদ (সা.) কে'ও হালিমা
বিনতে আবু জুয়াইবের হাতে দিয়ে দেওয়া হয় । এই শিশুকে ঘরে আনার পর দেখা
যায় হালিমার সচ্ছলতা ফিরে আসে এবং তারা শিশুপুত্রকে সঠিকভাবে লালনপালন করতে সমর্থ
হন । তখনকার একটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য:
শিশু মুহাম্মাদ কেবল হালিমার একটি স্তনই পান করতেন এবং অপরটি তার
অপর দুধভাইয়ের জন্য রেখে দিতেন ।
এই ঘটনার পরই হালিমা মুহাম্মাদ (সা.) কে মা আমিনার
কাছে ফিরিয়ে দেন । ছয় বছর বয়স পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত তিনি মায়ের সাথে কাটান । এই
সময় একদিন মা আমিনার ইচ্ছা হয় ছেলেকে নিয়ে মদিনায় যাবেন । সম্ভবত কোনো
আত্মীয়ের সাথে দেখা করা এবং স্বামীর কবর জিয়ারত করাই এর কারণ ছিল । মা আমিনা, ছেলে, শ্বশুর এবং সঙ্গী উম্মে
আয়মনকে নিয়ে
৫০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে মদিনায় পৌঁছেন । তিনি মদিনায় একমাস সময় অতিবাহিত
করেন । একমাস পর মক্কায় ফেরার পথে আরওয়া নামক
স্থানে এসে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন । মাতার
মৃত্যুর পর দাদা আবদুল
মুত্তালিব শিশু
মুহাম্মাদকে নিয়ে মক্কায় পৌঁছেন । এর পর থেকে দাদা-ই হযরত মুহাম্মাদ (সা) এর
দেখাশোনা করতে থাকেন । মুহাম্মাদ (সা.) এর বয়স যখন ৮
বছর ২ মাস ১০ দিন তখন তার দাদাও মারা যান । মৃত্যুর আগে তিনি তার পুত্র আবু
তালিবকে মুহাম্মাদ
(সা.) এর দায়িত্ব দিয়ে যান ।
আবু তালিব ব্যবসায়ী ছিলেন এবং আরবদের নিয়ম
অনুযায়ী বছরে একবার সিরিয়া সফরে যেতেন । মুহাম্মাদ (সা.) এর বয়স যখন ১২
বৎসর তখন তিনি চাচার সাথে সিরিয়া যাওয়ার জন্য বায়না ধরলেন । প্রগাঢ় মমতার কারণে
আবু তালিব আর নিষেধ করতে পারলেন না । যাত্রাপথে বসরা পৌঁছার
পর কাফেলাসহ আবু তালিব তাবু ফেললেন । সে সময় আরব উপদ্বীপের রোম অধিকৃত
রাজ্যের রাজধানী বসরা অনেক দিক দিয়ে সেরা ছিল । কথিত আছে, শহরটিতে জারজিস নামক
এক খ্রিষ্টান
পাদ্রি ছিলেন
যিনি বুহাইরা বা বহিরা নামেই
অধিক পরিচিত ছিলেন । তিনি তার গির্জা হতে বাইরে এসে কাফেলার মুসাফিরদের মেহমানদারী
করেন । এ সময় তিনি বালক মুহাম্মাদ (সা.) কে দেখে শেষ নবী হিসেবে চিহ্নিত
করেন । ফিজারের যুদ্ধ যখন
শুরু হয় তখন নবীর বয়স ১৫ বছর । এই যুদ্ধে তিনি স্বয়ং অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধের
নির্মমতায় তিনি অত্যন্ত ব্যথিত হন । কিন্তু তাঁর কিছু করার ছিল না । সে সময় থেকেই
তিনি কিছু একটি করার চিন্তাভাবনা শুরু করেন । তার উত্তম চরিত্র ও সদাচরণের কারণে
পরিচিত মহলের সবাই তাকে "আল-আমিন"
"আল-সিদ্দিক" বলে সম্বোধন করতেন ।
নবুয়তপূর্ব জীবনঃ
আরবদের মধ্যে বিদ্যমান হিংস্রতা, খেয়ানতপ্রবণতা এবং প্রতিশোধস্পৃহা দমনের জন্যই মুহাম্মাদ(সঃ) হিলফুল ফুজুল নামক সংঘ তৈরি করেন এবং এই সংঘকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে তিনি বিরাট ভূমিকা রাখেন ।
বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় তরুণ বয়সে মুহাম্মদ(সঃ) এর তেমন কোনো পেশা ছিল না। তবে তিনি বকরি
চরাতেন বলে অনেকেই উল্লেখ করেছেন । পরে তিনি ব্যাবসা শুরু করেন এবং অল্প সময়ের মধ্যেই একাজে
ব্যাপক সফলতা লাভ করেন । ব্যবসায় উপলক্ষে তিনি সিরিয়া, বসরা, বাহরাইন এবং ইয়েমেনে বেশ কয়েকবার সফর করেন। মুহাম্মাদ(সঃ) এর সুখ্যাতি
অবহিত হয়েই খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ তাকে নিজের ব্যবসার জন্য সফরে যাবার
অনুরোধ জানান । মুহাম্মাদ(সঃ) এই প্রস্তাব গ্রহণ করেন এবং খাদিজার পণ্য নিয়ে সিরিয়ার
অন্তর্গত বসরা পর্যন্ত যান।
খাদিজা মাইসারার মুখে মুহাম্মাদ(সা.) এর
সততা ও ন্যায়পরায়ণতার ভূয়সী প্রশংশা শুনে অভিভূত হন । এছাড়া ব্যবসায়ের সফলতা
দেখে তিনি তাঁর যোগ্যতা সম্বন্ধেও অবহিত হন । এক
পর্যায়ে তিনি মুহাম্মাদ(সা.) কে বিবাহ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন । বিয়ের সময়
খাদিজার বয়স ছিল ৪০ আর মুহাম্মাদ(সা.) এর বয়স ছিল ২৫ । খাদিজার জীবদ্দশায় তিনি
আর কোনো বিয়ে করেন নি । খাদিজার গর্ভে মুহাম্মাদের(সা.) ছয় জন সন্তান জন্মগ্রহণ
করে যার মধ্যে চার জন মেয়ে এবং দুই জন ছেলে । ছেলে সন্তান দুজনই শৈশবে মারা যায় । মেয়েদের মধ্যে সবাই ইসলামী যুগ পায় এবং ইসলাম গ্রহণ করে এবং একমাত্র ফাতিমা
ব্যতিত সবাই নবীর জীবদ্দশাতেই মৃত্যুবরণ করে ।
নবুওয়ত প্রাপ্তি
চল্লিশ বছর বয়সে ইসলামের নবী মুহাম্মাদ(সা.) নবুওয়ত লাভ
করেন,
অর্থাৎ এই সময়েই সৃষ্টিকর্তা তাঁর কাছে বাণী প্রেরণ করেন । ত্রিশ
বছর বয়স হয়ে যাওয়ার পর মুহাম্মাদ(সা.) প্রায়ই মক্কার অদূরে হেরা
গুহায় ধ্যানমগ্ন
অবস্থায় কাটাতেন । তাঁর স্ত্রী খাদিজা নিয়মিত
তাঁকে খাবার দিয়ে আসতেন । হাদিসের বর্ণনা অনুযায়ী এমনি একদিন ধ্যানের সময় ফেরেশতা জিবরাইল(আঃ) তার
কাছে আল্লাহ প্রেরিত
বাণী নিয়ে আসেন এবং
তাকে এই পংক্তি কটি পড়তে বলেনঃ
“
|
পাঠ করুন, আপনার পালনকর্তার নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন
মানুষকে জমাট রক্তপিণ্ড থেকে। পাঠ করুন, আপনার পালনকর্তা মহা দয়ালু, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন, শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানত না।
|
”
|
উত্তরে মুহাম্মাদ (সা.) জানান যে তিনি পড়তে জানেন
না,
এতে জিবরাইল তাঁকে জড়িয়ে ধরে প্রবল চাপ প্রয়োগ করেন এবং আবার একই
পংক্তি পড়তে বলেন। কিন্তু এবারও মুহাম্মাদ(সা.) নিজের অপারগতার কথা প্রকাশ করেন।
এভাবে তিনবার চাপ দেওয়ার পর মুহাম্মাদ(সা.) পংক্তিটি পড়তে সমর্থ হন। এটিই
কুরআনের প্রথম আয়াত গুচ্ছ; সুরা আলাকের প্রথম
পাঁচ আয়াত। একটি
লম্বা বিরতির পর তাঁর কাছে দ্বিতীয় বারের মতো স্রষ্টার বাণী আসে। এবার অবতীর্ণ
হয় সুরা
মুদ্দাস্সির-এর কয়েকটি আয়াত। এর পর থেকে গোপনে ইসলাম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন
মুহাম্মাদ।
গোপন প্রচার
প্রত্যাদেশ অবতরণের পর মুহাম্মাদ (সা.) বুঝতে পারেন
যে,
এটি প্রতিষ্ঠা করতে হলে তাকে পুরো আরব সমাজের প্রতিপক্ষ হিসেবে
দাঁড়াতে হবে; কারণ তৎকালীন নেতৃত্বের ভীত ধ্বংস করা ব্যতীত
ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠার অন্য কোনো উপায় ছিল না। তাই প্রথমে তিনি নিজ
আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের মাঝে গোপনে ইসলামের বাণী প্রচার শুরু করেন।
মুহাম্মাদ (সা.) এর আহ্বানে ইসলাম গ্রহণকারী প্রথম ব্যক্তি ছিলেন তার সহধর্মিণী খাদিজা। এরপর
মুসলিম হন মুহাম্মাদ (সা.) এর চাচাতো ভাই এবং তাঁর ঘরেই প্রতিপালিত কিশোর আলি, ইসলাম গ্রহণের সময় তার বয়স ছিল মাত্র ১০। ইসলাম
গ্রহণকারী তৃতীয় ব্যক্তি ছিল নবীর অন্তরঙ্গ বন্ধু আবু বকর। এভাবেই
প্রথম পর্যায়ে তিনি ইসলাম প্রচারের কাজ শুরু করেন এবং এই প্রচারকাজ চলতে থাকে
সম্পূর্ণ গোপনে।
প্রকাশ্য দাওয়াত
তিন বছর গোপনে দাওয়াত দেওয়ার পর মুহাম্মাদ প্রকাশ্যে
ইসলামের প্রচার শুরু করেন। মুহাম্মাদের বিরুদ্ধবাদীরা কয়েকটি স্তরে তাঁর উপর
নির্যাতন শুরু করে। একই
সাথে তৎকালীন আরব কবি ও চাটুকারদের নিয়ে গড়ে তোলা হয় মনোরঞ্জক সাহিত্য ও
গান-বাজনার দল,
এমনকি এক পর্যায়ে মুহাম্মাদের সাথে আপোসেরও প্রচেষ্টা চালায়
কুরাইশরা। কিন্তু মুহাম্মাদ তা মেনে নেন নি; কারণ আপোসের
শর্ত ছিল প্রচারবিহীনভাবে ইসলাম পালন করা অথবা বহুঈশ্বরবাদী পৌত্তলিকতাকে সমর্থন
করে ইসলাম প্রচার করা, অথচ প্রতিমাবিহীন একেশ্বরবাদের দিকে
মানুষকে ডাকাই ছিল তার ধর্ম প্রচারের সর্বপ্রথম ঐশী দ্বায়িত্ব।[৪০]
ইথিওপিয়া (আবিসিনিয়ায়) হিজরত
ধীরে ধীরে যখন মুসলিমদের বিরুদ্ধে সহিংসতা চরম রূপ
ধারণ করে,
তখন নবী কিছু সংখ্যক মুসলিমকে আবিসিনিয়ায়
হিজরত করতে
পাঠান। সেখান থেকেও কুরাইশরা মুসলিমদের ফেরত আনার চেষ্টা করে, যদিও তৎকালীন আবিসিনিয়ার সম্রাট নাজ্জাশির কারণে
তা সফল হয় নি।
গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ইসলাম গ্রহণ
এরপর ইসলামের ইতিহাসে যে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি ঘটে
তা হল মুহাম্মাদ এর
চাচা হামজা এবং
কুরাইশ নেতা উমর
ইবনুল খাত্তাবের ইসলাম
গ্রহণ। উমরের ইসলাম গ্রহণে মুসলিমদের আধিপত্য আরও মজবুত হয় এবং তখন থেকে উমরের
সাথে কাবা প্রাঙ্গণে প্রকাশ্যে উপাসনা করা শুরু করেন।
দুঃখের বছর ও তায়েফ গমন
মুক্তির পরের বছর ছিল মুহাম্মাদের জন্য দুঃখের বছর।
কারণ এই বছরে খুব স্বল্প সময়ের ব্যবধানে তার স্ত্রী খাদিজা ও
চাচা আবু
তালিব মারা
যায়। হতাশ হয়ে তিনি ইসলাম প্রচারের জন্য তায়েফ যান ।
কিন্তু সেখানে ইসলাম প্রচার করতে গেলে তায়েফের লোকজন তাদের কিশোর-তরুণদেরকে
মুহাম্মাদের পিছনে লেলিয়ে দেয়; তারা ইট-প্রস্তরের আঘাতে তাকে
রক্তাক্ত করে দেয়। কিন্তু তবুও তিনি হাল ছাড়েন নি; বরং
সেখানেও তিনি ইসলাম প্রসারের সম্ভবনার কথা চিন্তা করতে থাকেন।
মদিনায় হিজরত
মুহাম্মাদের আহ্বানে মদীনায় বেশকিছু লোক ইসলামের
প্রতি উৎসাহী হয়ে ইসলাম গ্রহণ করে। তারা মূলত হজ্জ করতে
এসে ইসলামে দাওয়াত পেয়েছিল। এরা আকাবা নামক
স্থানে মুহাম্মাদের কাছে শপথ করে যে তারা যে কোনো অবস্থায় তাদের নবী মুহাম্মাদকে
রক্ষা করবে এবং ইসলামে প্রসারে কাজ করবে। একসময় মদিনার ১২ টি গোত্রের নেতারা একটি
প্রতিনিধিদল প্রেরণের মাধ্যমে মুহাম্মাদকে মদিনায় আসার আমন্ত্রণ জানায়। মদিনা
তথা ইয়াসরিবে অনেক আগে থেকে প্রায় ৬২০ সাল পর্যন্ত গোত্র গোত্র এবং ইহুদিদের
সাথে অন্যদের যুদ্ধ লেগে থাকে। বিশেষত বুয়াছের যুদ্ধে সবগুলো গোত্র যুদ্ধে অংশ
নেওয়ায় প্রচুর রক্তপাত ঘটে[৪১]। এ
থেকে মদিনার লোকেরা বুঝতে সমর্থ হয়েছিল যে, রক্তের বিনিময়ে রক্ত
নেওয়ার নীতিটি এখন আর প্রযোজ্য হতে পারে না। এজন্য তাদের একজন নেতা দরকার যে সবাইকে
একতাবদ্ধ করতে পারবে। এ চিন্তা থেকেই তারা মুহাম্মাদকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল ,
যদিও আমন্ত্রণকারী অনেকেই তখনও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে নি। এই
আমন্ত্রণে মুসলিমরা মক্কা থেকে হিজরত করে
মদিনায় চলে যায়। সবশেষে মুহাম্মাদ ও আবু বকর ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে
মদিনায় হিজরত করেন। তাদের হিজরতের দিনেই কুরাইশরা
মুহাম্মাদকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল যদিও তা সফল হয় নি।
স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও সংবিধান
প্রণয়ন
মুহাম্মাদ মদিনায় গিয়েছিলেন একজন মধ্যস্থতাকারী
এবং শাসক হিসেবে। তখন বিবদমান দুটি মূল পক্ষ ছিল বনু আওস ও বনু
খাজরাজ। তিনি তার দায়িত্ব সুচারুরূপে পালন
করেছিলেন। মদিনার সকল গোত্রকে নিয়ে ঐতিহাসিক মদিনা সনদ স্বাক্ষর
করেন যা পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম সংবিধান হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। এই সনদের
মাধ্যমে মুসলিমদের মধ্যে সকল রক্তারক্তি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এই
সনদের মাধ্যমে মদিনা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং মুহাম্মাদ হন
তার প্রধান।
মক্কার সাথে বিরোধ ও যুদ্ধ
মুহাম্মাদ মদিনায় এসে আশেপাশের সকল গোত্রের সাথে
সন্ধি চুক্তি স্থাপনের মাধ্যমে শান্তি স্থাপনে অগ্রণী ছিলেন।কিন্তু মক্কার
কুরাইশরা গৃহত্যাগী সকল মুসলিমদের সম্পত্তি ছিনিয়ে নেয়। এই অবস্থায় ৬২৪ সালে
মুহাম্মাদ ৩০০ সৈন্যের একটি সেনাদলকে মক্কার একটি বাণিজ্যিক কাফেলাকে বাধা দেওয়ার
উদ্দেশ্যে পাঠায়। কারণ উক্ত কাফেলা বাণিজ্যের নাম করে অস্ত্র সংগ্রহের চেষ্টা
করছিল। কুরাইশরা তাদের কাফেলা রক্ষায় সফল হয়। কিন্তু এই প্রচেষ্টার প্রতিশোধ
নেওয়ার জন্য যুদ্ধের ডাক দেয়। আত্মরক্ষামূলক এই যুদ্ধে মুসলিমরা সৈন্য সংখ্যার
দিক দিয়ে কুরাইশদের এক তৃতীয়াংশ হয়েও বিজয় অর্জন করে। এই যুদ্ধ বদর
যুদ্ধ নামে
পরিচিত যা ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৫
মার্চ তারিখে
সংঘটিত হয়। এই সময় থেকেই ইসলামের সশস্ত্র ইতিহাসের সূচনা ঘটে। এরপর ৬২৫ সালের ২৩
মার্চে উহুদ
যুদ্ধ সংঘটিত
হয়। এতে মুসলিমরা পরাজিত হয়। ৬২৭ সালে আবু
সুফিয়ান কুরাইশদের
আরেকটি দল নিয়ে মদিনা আক্রমণ করে। কিন্তু এবারও খন্দকের
যুদ্ধে মুসলিমদের
কাছে পরাজিত হয়। যুদ্ধ বিজয়ে উৎসাহিত হয়ে মুসলিমরা আরবে একটি প্রভাবশালী
শক্তিতে পরিণত হয়।
হুদাইবিয়ার সন্ধি
কুরাইশদের শত্রুতার কারণে মুসলিমরা হজ্জ আদায় করতে
পারছিল না। মুহাম্মাদ এক দিব্যদর্শনে দেখতে পান তিনি হজ্জের জন্য মাথা কামাচ্ছেন।
এ দেখে তিনি হজ্জ করার জন্য মনস্থির করেন এবং ৬ হিজরি সনের শাওয়াল মাসে হজ্জের
উদ্দেশ্যে ১৪০০ সাহাবা নিয়ে
মক্কার পথে যাত্রা করেন। কিন্তু এবারও কুরাইশরা বাধা দেয়। অগত্যা মুসলিমরা মক্কার
উপকণ্ঠে হুদাইবিয়া নামক
স্থানে ঘাটি স্থাপন করে। এখানে কুরাইশদের সাথে মুসলিমদের একটি শান্তি চুক্তি
স্বাক্ষরিত হয় যা ইতিহাসে হুদাইবিয়ার
সন্ধি নামে সুপরিচিত। এই সন্ধি মতে মুসলিমরা সে বছর হজ্জ করা ছাড়াই মদিনায়
প্রত্যাবর্তন করে। সন্ধির অধিকাংশ শর্ত মুসলিমদের বিরুদ্ধে গেলেও মুহাম্মাদ এই
চুক্তি সম্পাদন করেছিলেন।
বিভিন্ন রাষ্ট্রনায়কদের কাছে পত্র প্রেরণ
হুদায়বিয়ার সন্ধির পর কুরাইশ ও অন্যান্য আরব গোত্রগুলো
থেকে আশ্বস্ত হয়ে তিনি বিভিন্ন রাষ্ট্রনায়কদের কাছে
পত্র প্রেরণের কাজে মনোনিবেশ করেন। সে সময়ে পৃথিবীর প্রধান রাজশক্তিগুলো
ছিল ইউরোপের রোম সাম্রাজ্য, এশিয়ার পারস্য সাম্রাজ্য এবং আফ্রিকার
হাবশা সাম্রাজ্য। এছাড়াও মিশরের 'আজিজ মুকাউকিস', ইয়ামামার সর্দার এবং সিরিয়ার গাসসানী শাসনকর্তাও বেশ প্রতাপশালী ছিল। তাই
ষষ্ঠ হিজরির জিলহজ মাসের শেষদিকে একইদিনে এদেঁর কাছে ইসলামের আহ্বানপত্রসহ সাতজন
দূত প্রেরণ করেন।
প্রেরিত দূতগণের তালিকা
1.
দাহিয়া কালবি কে
রোমসম্রাট কায়সারের (হিরাক্লিয়াস বা হিরাকল নামে অধিক পরিচিত) কাছে ।
2.
আবদুল্লাহ বিন
হুযায়ফা আস-সাহমিকে পারস্যসম্রাট কিসরা বা খসরু পারভেজের কাছে ।
3. হাতিব বিন আবু বুলতা'আ কে মিশরের (তৎকালীন আলেকজান্দ্রিয়ার) শাসনকর্তা মুকাউকিসের কাছে।
4.
আমর বিন উমাইয়া
কে হাবশার রাজা নাজ্জাশির কাছে ।
5.
সলিত বিন উমর বিন
আবদে শামস কে ইয়ামামার সর্দারের কাছে ।
6.
শুজা ইবনে
ওয়াহাব আসাদি কে গাসসানী শাসক হারিসের কাছে ।
7.
আল আলা আল
হাদরামিকে বাহরাইনের শাসক মুনজির ইবন সাওয়া আল তামিমি'র কাছে ।
শাসকদের মধ্য হতে বাদশাহ নাজ্জাসি ও মুনজির ছাড়া আর কেউ তখন
ইসলাম গ্রহণ করেন নি ।
মক্কা বিজয়
খুজাআহ গোত্র ছিল মুসলমানদের মিত্র, অপরদিকে তাদের শত্রু বকর গোত্র ছিল কুরাইশদের মিত্র । একরাতে
বকর গোত্র খুজাআদের উপর অতর্কিত হামলা চালায় । কুরাইশরা এই
আক্রমণে অন্যায়ভাবে বকর গোত্রকে অস্ত্র দিয়ে সহযোগিতা করে । কুরাইশদের কিছু যুবকও
এই হামলায় অংশগ্রহণ করে । এই ঘটনার পর মুহাম্মাদ কুরাইশদের কাছে তিনটি শর্তসহ পত্র
প্রেরণ করেন এবং কুরাইশদেরকে এই তিনটি শর্তের যে কোনো একটি মেনে নিতে বলেন । শর্ত
তিনটি হলোঃ
·
কুরাইশ খুজাআ
গোত্রের নিহতদের রক্তপণ শোধ করবে ।
·
অথবা তারা বকর
গোত্রের সাথে তাদের মৈত্রীচুক্তি বাতিল ঘোষণা করবে ।
·
অথবা এ ঘোষণা
দিবে যে,
হুদায়বিয়ার সন্ধি বাতিল করা হয়েছে এবং কুরাইশরা যুদ্ধের
জন্য প্রস্তুত ।
কুরাইশরা জানালো যে, তারা শুধু
তৃতীয় শর্তটি গ্রহণ করবে । ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দে মুহাম্মাদ দশ হাজার সাহাবীর বিশাল
বাহিনী নিয়ে মক্কাভিমুখে রওয়ানা হলেন । সেদিন ছিল অষ্টম হিজরির রমজান মাসের দশ
তারিখ । সংঘর্ষ ছাড়া বিনাপ্রতিরোধে মক্কা বিজিত হলো এবং মুহাম্মাদ(সঃ) বিজয়ীবেশে
সেখানে প্রবেশ করলেন । তিনি মক্কাবাসীর জন্য সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা দিলেন । মক্কায়
প্রবেশ করেই মুহাম্মাদ(সঃ) সর্বপ্রথম কাবাঘরে আগমন করেন এবং সেখানকার সকল মূর্তি ধ্বংস
করেন । মুসলমানদের
শান-শওকত দেখে এবং মুহাম্মাদ এর ক্ষমাগুণে মুগ্ধ হয়ে অধিকাংশ মক্কাবাসীই ইসলাম
গ্রহণ করে ।
মৃত্যু
বিদায় হজ্জ থেকে ফেরার পর হিজরি ১১ সালের সফর মাসে
মুহাম্মাদ জ্বরে আক্রান্ত হন । জ্বরের তাপমাত্রা প্রচণ্ড হওয়ার কারণে পাগড়ির উপর
থেকেও উষ্ণতা অনুভূত হচ্ছিল । অসুস্থ অবস্থাতেও তিনি এগারো দিন নামাজের ইমামতি
করেন । অসুস্থতা তীব্র হওয়ার পর তিনি সকল স্ত্রীর অনুমতি নিয়ে আয়িশার গৃহে
অবস্থান করতে থাকেন । বলা হয়, এই অসুস্থতা ছিল খাইবারের এক ইহুদি
নারীর তৈরি বিষ মেশানো খাবার গ্রহণের কারণে । স্ত্রী আয়িশার কোলে মাথা রেখে,
তিনি আয়িশাকে তার সর্বশেষ পার্থিব সম্পত্তি (সাত কিংবা আট দিনার)
দান করে দিতে বলেন এরপর তিনি তার জীবনের সর্বশেষ উক্তিটি উচ্চারণ করেনঃ
“
|
হে আল্লাহ, তুমি আর-রফিক আল-আ'লা (শ্রেষ্ঠ বন্ধু, সর্বোচ্চ আবাস বা সর্বোন্নত, স্বর্গের সর্বোচ্চ সঙ্গ)
|
”
|
অবশেষে ৮ই জুন ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে রবিবারে বা ১১
হিজরি সালের রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ সন্ধ্যায় তিনি মদিনায় আয়িশার গৃহে
মৃত্যুবরণ করেন । এ
সময় তার বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর । আলি তাকে
গোসল দেন এবং কাফন পরান । আয়েশার ঘরের যে স্থানে তিনি মৃত্যুবরণ করেন, জানাজার পর সেখানেই তাকে দাফন করা হয় ।
অমুসলিমদের দৃষ্টিভঙ্গি
ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন
বোনাপার্ট মুহাম্মাদ(সঃ) কে
একজন আদর্শ আইন নির্মাতা এবং মহামানব আখ্যা দিয়ে মুহাম্মাদ(সঃ) এবং ইসলামের ভূয়সী
প্রশংসা করেন ।ইতিহাসবিদ টমাস
কার্লাইল এবং
উইলিয়াম মন্টমেগেরি ওয়াট তাদের
নিজ নিজ বইয়ে মুহাম্মাদকে ইতিহাসের একজন অন্যতম প্রভাবশালী ইতিবাচক সংস্কারক
হিসেবে উল্লেখ করেন । এছাড়া মাইকেল এইচ. হার্ট তার বিশ্বের
শ্রেষ্ঠ একশ মনীষী নামক
জীবনীগ্রন্থে মুহাম্মাদ কে প্রথম স্থানে রেখেছেন ।
Source: https://bn.wikipedia.org
No comments:
Post a Comment